আমিরুজ্জামান সুমনঃ নাম হালিম মিয়া। বয়স আনুমানিক ৫২। ২ ছেলে ১ মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন সুদুর আমেরিকায়। ৪৬ বছর পর গত ১৭ জুলাই সোমবার নাড়ীর টানে সুদুর আমেরিকা থেকে ছূটে এসছেন রংপুরের মিঠাপুকুরের নিভৃত পল্লী উপজেলার ১৫ নং হযরতপুর ইউনিয়নের নওয়াপুকুর গ্রামে। তিনি বিদেশী নামে এলাকায় পরিচিত।

সরজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে এলাকাবাসী ও হালিম মিয়ার সাথে কথা হলে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি গল্পটা জানা যায়। হালিমের বাবা ফজর উদ্দিন গ্রামে গ্রামে ঠাটারির কাজ করে বেড়াতেন। তিনি নোয়াখালী জেলায় ১ম বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের ঘরে ১ ছেলে সন্তান হালিম মিয়া ও ১টি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। এরপর হালিমের বাবা ফজর উদ্দিন আরও ২টি বিয়ে করেন। সেই স্ত্রীদেরও সন্তান সন্ততি হয়। যুদ্ধের পর বাবা ফজর উদ্দিন মারা গেল। হালিমের অভাবের সংসার থমকে দাঁড়ালো। হালিমের মা, হালিম ও তার ছোট বোনকে নিয়ে নোয়াখালী তাদের নানা বাড়ি চলে যায় ১৯৭৪ সালের দিকে। নোয়াখালী থেকে জনৈক প্রবাসী হালিমকে (৬) লালন পালনের দায়িত্ব নিয়ে তাকে নিয়ে চলে যান সুদুর আমেরিকায়। সেখানে তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেন।

মা আর ছোট বোনের সাথে যোগাযোগ ছিল হালিমের। কিন্তু ফেলে আসা গ্রামের সেই মানুষগুলোর বিষয়ে কিছুই জানতেন না আব্দুল হালিম। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় আমেরিকায় যেখানে থাকেন তার পাশেই হালিমও থাকেন বলে জানালেন। হালিম বিয়ে করেছেন আমেরিকার স্বনামধন্য একজন সাইন্টিস্টকে। তার বাড়ি জার্মানি। দেশ নিয়ে গ্রাম নিয়ে সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে প্রায় কথা হয় বলে জানালেন হালিম। বললেন গ্রামের জন্য তারও মন কাঁদে। কিন্তু সুযোগ কম হয় তাই আসতে পারে না। আমারও একই অবস্থা ৫টি ফ্যাক্টরী আমার। সেগুলোর দেখাশুনা ২ ছেলে ১ মেয়ে তাদের লেখাপড়া। স্ত্রী সাইন্টিস্ট তিনিও সবসময় ব্যস্ত থাকেন। আমার মন খুব চায় আসতে কিন্তু পারি না।
গত ২০১৬ সালের দিকে হালিম তার ঢাকায় অবস্থানকারী ছোট বোনকে ফোন দেয়।বলেন, মিঠাপুকুরে আমাদের গ্রামের বাড়ির কোন সদস্য বেঁচে কিনা? তার ছোট বোন এসে তার অন্য ২ মায়ের সন্তানদের খোঁজ পান। এরপর সেই সৎ ভাই বোনদের সাথে যাতায়াত যোগাযোগ শুরু হয়। প্রায় ৪৫ বছর পর। এর মধ্যে হালিম মিঠাপুকুরের নিভৃত পল্লী নওয়াপুকুর গ্রামে তার সৎ ভাইদের জন্য পাকা বাড়ি করে দিয়েছেন। বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা মৃত্যু বরণ করেছেন তাদের কবর পাকা করেন। ছোট বোনের ঢাকায়

বিয়ে দিয়েছেন। সেই ৬ বছরের ছোট্র হালিম যে দু বেলা এক মুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করেছে তিনি ৪৬ বছর পর ১৭ জুলাই আমেরিকা থেকে হেলিকপ্টারে করে তার গ্রামের বাড়ি আসার মনঃস্থির করলেন। ওই দিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় হাজার হাজার উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছেন তাদের হালিমকে দেখার জন্য। অবশেষে বিকেলে হালিম আমেরিকা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে তার গ্রামের বাড়িতে আসলেন সাথে ১ ছেলে ১ মেয়েকে নিয়ে। করতালি আর আনন্দে মুখরিত পুরো ইউনিয়ন। তার জন্য তৈরী করা হয়েছে গেট। বিতরণ করা হলো মিষ্টি। মোতায়েন ছিল পুলিশ। ৩ দিনের তার এই সফরের ২য় দিন কথা হলো হালিমের সাথে। বললাম আপনি এলাকার মানুষদের চিনছেন? হেসে বললেন শুধু বুড়াদের চিনছি। চোখ দেখে। আর যুবকরা পরিচয় দিচ্ছে মাথায় ক্যাচ করছি। আপনার ইচ্ছা কি? বললেন এলাকার মানুষের জন্য কিছু করা। প্রচন্ড গরমের দুপুরে ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাবার কবরে মাটি দিলেন জিয়ারত করলেন। বললেন বাবার কবরে মাটি দেয়ার জন্যই আমি এসেছি। আমার মন অনেক শান্তি পেয়েছে। আমার ছেলে মেয়ে তাদের দাদার কবরে মাটি দিল তারাও খুব খুশি। থাকবেন কতদিন? বললেন ১৯ জুলাই নানা বাড়ি নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাব। পরিবারের সৎ ভাইয়েরা জারপর নেই আনন্দ। বললেন সৎ ভাই সাধারণত হিংসুক হয়। কিন্তু হালিম সৎ শব্দটিকে সৎ(ভাল) হিসেবেই মর্যাদা দিয়েছেন। আমার ভাইকে আল্লাহ্ দীর্ঘজীবন দান করুন।

শেষে আব্দুল হালিম মিয়া বলেন আপনারা সবাই ভাল থাকেন। আমার জন্য দোয়া করেন। আধো বাংলা আর ইংরেজী মিষিয়ে কথা বলছেন হালিম। পুরো গ্রাম ব্যস্ত। হালিম আচ্ছে। হামার ছোল আচ্ছে। যেন ঈদের আনন্দে ভাষছে পুরো গ্রাম। উপজেলার বেশ কয়েকজন বলেন হালিমের গল্প সিনেমা, নাটক কিংবা স্বপ্নকেও হার মানাবে। এই এলাকার মানুষ কেউ স্বপ্নেও এমন গল্প শোনেনি। সফরের ২য় দিনেও বিভিন্ন উপজেলা থেকে শত শত মানুষের ভীড় দেখা গেছে। ১৯ জুলাই তিনি নোয়াখালীর উদ্দেশে গ্রামের বাড়ি থেকে যাবেন। আবার সময় করে আসবেন। এলাকার উন্নয়ন করার পরিকল্পনা তিনি বাস্তবায়ন করবেন বলে এলাকাবাসী আশা প্রকাশ করলেন।

valo laglo